এস এম আওলাদ হোসেন, সাংবাদিক ও কলামিস্ট।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক আজ আমাদের দৈনন্দিন জীবনের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। সকাল ঘুম থেকে উঠে অনেকেই প্রথমেই ফেসবুক স্ক্রল করেন। আত্মীয়-স্বজনের খোঁজ নেওয়া, খবর জানা বা বিনোদনের জন্য নয়, বরং এখন এটি এক ধরনের প্রতিযোগিতা ও প্রদর্শনের প্ল্যাটফর্মে পরিণত হয়েছে। বিশেষ করে সাম্প্রতিক সময়ে নারী ব্যবহারকারীদের মধ্যে একটি নতুন প্রবণতা চোখে পড়ছে—লাইভে এসে বা পোস্টে লিখছেন: “আমার পরিবারে আসুন (মানে ফলো করুন), একটু ভালোবাসা দিয়ে যান (মানে স্টার পাঠান), আমার বাড়িতে আসুন (মানে ফ্রেন্ডলিস্টে যুক্ত হোন)।”
এটি নিছক নির্দোষ আহ্বান নয়, বরং একটি নতুন ডিজিটাল ভিক্ষাবৃত্তির সংস্কৃতি, যা আমাদের সমাজে নীরবে শেকড় গেড়ে বসছে।
মানুষ স্বভাবতই স্বীকৃতি পেতে চায়। প্রাচীন যুগে মানুষ এই স্বীকৃতি পেত পরিবার, সমাজ ও কর্মক্ষেত্রে অবদান রাখার মাধ্যমে। আজকের দিনে সেই চাহিদা পূরণ হচ্ছে “লাইক, কমেন্ট, ফলোয়ার ও স্টার”-এর মাধ্যমে। ফরাসি সমাজবিজ্ঞানী গি দ্য বোর্দ তাঁর “The Society of the Spectacle” গ্রন্থে বলেছেন—আধুনিক সমাজ বাস্তবতার চেয়ে প্রদর্শনকে (spectacle) বেশি গুরুত্ব দেয়। আমাদের চারপাশে ঠিক সেটাই ঘটছে।
এখন প্রশ্ন হলো, কেন মানুষ “স্টার” নামক ভার্চুয়াল পুরস্কারের জন্য এতটা মরিয়া ? একদিকে আর্থিক লোভ—ফেসবুক স্টার দিয়ে আয়ের সুযোগ রাখলেও এর প্রকৃত চিত্র প্রতারণার মতো। অন্যদিকে সামাজিক প্রদর্শন—“আমাকে ফলো করছে”, “আমাকে স্টার পাঠিয়েছে” এই দম্ভ দেখানো।
তৃতীয়ত যৌন প্রলোভন—কিছু পুরুষ ব্যবহারকারী মহিলাদের আকৃষ্ট করতে, আর কিছু মহিলা ব্যবহারকারী সেই প্রলোভন কাজে লাগিয়ে উপকৃত হতে চাইছেন। এভাবে ধীরে ধীরে আমাদের সমাজে জন্ম নিচ্ছে এক ধরনের অপসংস্কৃতি, যা মূলত আত্মমর্যাদা খর্ব করছে।
অনেকে মনে করেন ফেসবুক থেকে আয় করা সহজ। বাস্তবতা হলো—১০,০০০ স্টার জমলে কেবলমাত্র অর্থ উত্তোলনের সুযোগ রয়েছে।
একজন ব্যবহারকারীকে একটি স্টার কিনতে খরচ করতে হয় প্রায় ৩ টাকা, অথচ নির্মাতা পান মাত্র ৮০ পয়সা। অর্থাৎ প্রকৃত লাভ হচ্ছে ফেসবুকের, ব্যবহারকারীরা হচ্ছে কেবল শিকার।
তাহলে কেন এই “স্টার ব্যবসা”? আসলে এটি একধরনের মানসিক ফাঁদ। সামান্য টাকার লোভে মানুষ আসলে নিজের ব্যক্তিত্ব, গোপনীয়তা এমনকি নৈতিকতাকেও বিকিয়ে দিচ্ছেন।
আমাদের ইতিহাসে বিনোদন ও সংস্কৃতি সবসময়ই সামাজিক মূল্যবোধের সঙ্গে যুক্ত ছিল। জারি-সারি গান, যাত্রাপালা, পালাগান—এসবই ছিল বিনোদনের মাধ্যম, কিন্তু তার মধ্যে অশ্লীলতা নয়, বরং কণ্ঠশিল্প, প্রতিভা ও সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ ফুটে উঠত। আজকের ফেসবুক সংস্কৃতি তার সম্পূর্ণ উল্টো। এখানে প্রতিভার চেয়ে গুরুত্ব পাচ্ছে অশ্লীলতা ও সস্তা বিনোদন।
গল্পে যেমন বলা হয়—রাজা ল্যাংটা হলেও ভয়ে কেউ সত্য বলতে পারে না। আমাদের সমাজে আজ অনেকেই সেই “ল্যাংটা রাজার” ভূমিকায়। তারা মনে করছে অশ্লীল প্রদর্শনই স্বাভাবিক। আর যারা প্রতিবাদ করছে, তারা যেন ব্যতিক্রম।
১. পরিবারে ভাঙন: ফেসবুকের অযথা আসক্তি স্বামী-স্ত্রী ও সন্তানদের মধ্যে দূরত্ব তৈরি করছে।
২. নারী মর্যাদা ক্ষুণ্ণ: নারীরা নিজেরাই নিজেদের মর্যাদাকে প্রশ্নবিদ্ধ করছেন স্টারের জন্য ভিক্ষা করে।
৩. অর্থনৈতিক ক্ষতি: মানুষ টাকা খরচ করছে ফেসবুককে সমৃদ্ধ করতে, অথচ সমাজ পাচ্ছে না কোনো উপকার।
৪. যুব সমাজ বিপথগামী: তরুণ-তরুণীরা সহজ আয়ের মোহে নিজেদের প্রতিভা ও সময় নষ্ট করছে।
ফেসবুককে বিনোদন হিসেবে ব্যবহার করুন, জীবিকার মূল উৎস বানাবেন না। সন্তানদের অনলাইনের এই সংস্কৃতি থেকে রক্ষা করতে অভিভাবকদের সচেতন হতে হবে। মিডিয়া ও সমাজকর্মীদের উচিত এ বিষয়ে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করা। নারী ব্যবহারকারীদের উচিত আত্মমর্যাদা রক্ষা করে ফেসবুক ব্যবহার করা। প্রকৃত প্রতিভা থাকলে সমাজ সেটি একদিন চিনবেই।
ফেসবুকের স্টার আমাদের ভালোবাসা, সম্মান বা মর্যাদার মাপকাঠি নয়। ভালোবাসা আসে বাস্তব জীবনের সম্পর্ক থেকে, সম্মান আসে ব্যক্তিত্ব ও কর্মের মাধ্যমে। আমরা যদি এই ভুয়া প্রতিযোগিতা থেকে বেরিয়ে না আসি, তবে আমাদের সমাজকে একদিন পুরোপুরি গ্রাস করবে অপসংস্কৃতি।
তাই আসুন—ভালোবাসা দিই বাস্তব জীবনে, পরিবারের পাশে থেকে; স্টারের ভিক্ষার ঝলকানিতে নয়।
এস এম আওলাদ হোসেন
সাংবাদিক ও কলামিস্ট
01637654471