|
সাম্প্রতিক বাংলাদেশ-বিনা সংস্কারে গণতন্ত্র কেবল প্রদর্শনীয় মুখোশ।
এস এম আওলাদ হোসেন
|
|
এস এম আওলাদ হোসেন, সাংবাদিক ও কলামিস্ট।।
বাংলাদেশের রাজনীতি আজ এক চলন্ত চক্রে আবদ্ধ। নির্বাচন হয়, সরকার গঠিত হয়, কিন্তু জনগণের জীবনে গণতন্ত্রের প্রকৃত আলো পৌঁছায় না। ২০১৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচন, ইউনিয়ন পরিষদ ও স্থানীয় নির্বাচনের অভিজ্ঞতা দেখিয়েছে—ভোটের আনাগোনা ও ব্যালটবাক্সের আয়োজন থাকলেও প্রশাসনিক পক্ষপাত, দলীয়করণ এবং বিরোধী দলের অভিযোগের কারণে জনগণের আস্থা প্রশ্নবিদ্ধ।
গণতন্ত্র কেবল নির্বাচনের কোলাহল নয়; এটি হলো স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও মানুষের আস্থার প্রতিফলন। রাজনৈতিক সংস্কার ছাড়া এই ধারণা কেবল মরুভূমির মরীচিকার মতো—দূর থেকে ঝলমলে মনে হয়, কিন্তু কাছে গেলে শুষ্ক বালুর স্তূপ।
কাঠামোগত দুর্বলতা- ১.প্রতিষ্ঠানগত দখল
প্রশাসন, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ও স্থানীয় প্রশাসন রাজনৈতিক দলের প্রভাবাধীন। উদাহরণস্বরূপ, ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে নির্বাচনী এলাকা পর্যবেক্ষণে প্রশাসনিক পক্ষপাত লক্ষ্য করা গেছে।
২. নির্বাচনী প্রক্রিয়ার সীমাবদ্ধতা-নির্বাচন কমিশনের কার্যকারিতা সীমিত থাকলে ভোট কেবল আনুষ্ঠানিকতা হয়ে যায়। স্থানীয় নির্বাচনে ভোটার তালিকা, নিরাপত্তা ও পরিবেশ নিয়ে বারবার সমস্যা দেখা দেয়।
৩. দলীয় অভ্যন্তরীণ অগণতান্ত্রিকতা- রাজনৈতিক দলের ভেতরে স্বচ্ছ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন নেই। সাম্প্রতিক মনোনয়ন প্রক্রিয়াগুলো দেখিয়েছে—নেতৃত্বের ধারা পারিবারিক বা ব্যক্তিকেন্দ্রিক।
৪. বিচার ও গণমাধ্যমে রাজনৈতিক চাপ-বিচার ব্যবস্থা ও গণমাধ্যম স্বাধীন না হলে নির্বাচন ও রাজনৈতিক অস্বচ্ছতা জনগণের কাছে যথাযথভাবে পৌঁছায় না।
বাংলাদেশের রাজনীতি যেন এক ভাঙা গাড়ি। বাহ্যিক রঙ ও আলো ঠিক আছে, কিন্তু ইঞ্জিন অপরিবর্তিত। তাই রাস্তায় নামলেই থেমে যায়।
আর এটি মৃত বৃক্ষের মতো—যতই পানি ও সার দেওয়া হোক, নতুন কুঁড়ি ফোটে না। রাজনৈতিক সংস্কার ছাড়া নির্বাচন মানে মৃত বৃক্ষে ফুল ফোটার স্বপ্ন দেখা।
দক্ষিণ কোরিয়া: স্বৈরতন্ত্র ও দুর্নীতির শৃঙ্খল ভেঙে, স্বাধীন বিচারব্যবস্থা ও স্বচ্ছ প্রশাসন প্রতিষ্ঠা করে টেকসই গণতন্ত্র গড়ে তুলেছে।
জাপান: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী ধ্বংসস্তূপ থেকে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক সংস্কারের মাধ্যমে স্থিতিশীল গণতন্ত্র ও উন্নত অর্থনীতি অর্জন।
জার্মানি ও ইতালি: ফ্যাসিবাদের অন্ধকার থেকে মুক্তি পেয়ে সাংবিধানিক সংস্কার ও স্বাধীন প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করে স্থায়ী গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা।
এই উদাহরণগুলো দেখায়—সংস্কার ছাড়া নির্বাচন জনগণের আস্থা ফিরাতে পারে না।
বাংলাদেশের সংস্কারের এজেন্ডা- ১. স্বাধীন নির্বাচন কমিশন। কমিশনকে সরকারের প্রভাবমুক্ত করতে হবে, যাতে ভোটাধিকার সুরক্ষিত হয়।
২. দলীয়করণমুক্ত প্রশাসন-প্রশাসন জনগণের সেবক হবে, দলের হাতিয়ার নয়।
৩. দলীয় গণতন্ত্র-দলের অভ্যন্তরীণ নির্বাচন স্বচ্ছ ও অংশগ্রহণমূলক করতে হবে।
৪. স্বাধীন বিচার ও গণমাধ্যম-রাজনৈতিক চাপমুক্ত বিচার ও স্বাধীন সংবাদ মাধ্যম নিশ্চিত করতে হবে।
৫. দুর্নীতি দমন ও স্বচ্ছতা-বাজেট, রাজস্ব ও নির্বাচনী অর্থায়ন স্বচ্ছভাবে পরিচালনা করতে হবে।
৬. নাগরিক শিক্ষা ও অংশগ্রহণ-নাগরিকরা সচেতনভাবে রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় যুক্ত হলে নির্বাচন ফলপ্রসূ হবে।
২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচন: বিরোধী দল অভিযোগ করেছে ভোটের পরিবেশ প্রভাবিত ছিল, প্রশাসনের ভূমিকা একপক্ষীয় ছিল।
স্থানীয় নির্বাচন ও ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন: ভোটার তালিকা, নিরাপত্তা ও প্রশাসনিক পক্ষপাত নিয়ে বারবার উত্তেজনা।
রাজনৈতিক আন্দোলন ও সড়ক অবরোধ: জনগণ ও বিরোধী দলের প্রতিবাদের মাধ্যমে দেখা গেছে—নাগরিক আস্থা ও অংশগ্রহণের অভাব এখনও প্রবল।
এই ঘটনাগুলো দেখায়—সংস্কারের অভাব শুধুমাত্র নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় নয়, পুরো রাজনৈতিক কাঠামোয় সমস্যার মূল।
রাজনৈতিক সংস্কার ছাড়া বাংলাদেশের গণতন্ত্র ভেঙে পড়বে। নির্বাচনের আড়ম্বর থাকবে, কিন্তু জনগণের আস্থা অর্জিত হবে না। প্রশাসন দলীয় প্রভাবের নিচে থাকবে, বিচার ও গণমাধ্যম স্বাধীনতা হারাবে, এবং দুর্নীতি ও স্বৈরতন্ত্র প্রবণতা বৃদ্ধি পাবে।
ফলে—রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ব্যাহত হবে।
সামাজিক বিভাজন ও সংঘাত বৃদ্ধি পাবে।
জনগণের ভোট ও আস্থা মূল্যহীন হয়ে যাবে।
রাজনীতি যদি নদী হয়, তবে সংস্কার হলো তার বাঁধ। বাঁধ ছাড়া নদী ভেসে যায়, জনপদ ধ্বংস করে। তেমনি সংস্কারহীন রাজনীতি দুর্নীতি, স্বৈরতন্ত্র ও ক্ষমতার খেলায় ভেসে যায়।
বাংলাদেশে এখন প্রশ্ন একটাই—আমরা কি দক্ষিণ কোরিয়া, জার্মানি ও জাপানের মতো সংস্কারের পথ বেছে নেব, নাকি পুরনো মুখোশধারী গণতন্ত্রের চক্রে ঘুরপাক খেতে থাকব?
সাম্প্রতিক নির্বাচন ও রাজনৈতিক ঘটনাবলী স্পষ্ট করে দেখিয়েছে—রাজনৈতিক সংস্কার ছাড়া গণতন্ত্র কেবল মরুভূমির মরীচিকা। দূর থেকে ঝলমলে মনে হলেও কাছে গেলে কেবল শুষ্ক বালুর স্তূপ।
এস এম আওলাদ হোসেন।
সাংবাদিক ও কলামিস্ট।
01637654471
|
