গ্রাম্য রাজনীতির অপশক্তি ও আমাদের করণীয়
এস এম আওলাদ হোসেন
|
![]() এস এম আওলাদ হোসেন, সাংবাদিক ও কলামিস্ট।।
গ্রাম হল দেশের নেকড়ার কচকাড়ি -যেখানে মানুষের সরলতা, ভরসা ও আস্থা সবচেয়ে বেশি থাকে। কিন্তু সেই সরলতাকে কৌশলে কাজে লাগিয়ে গ্রাম্য রাজনীতি বহু প্রজন্মকে জিম্মি করে রেখেছে। যারা ভোটের জোরে, ভয়-ভীতি ও চাপের মাধ্যমে কর্তৃত্ব বিস্তার করে – তারা কুঠারে পেছন থেকে আঘাত করে সমাজের সবচেয়ে দুর্বল স্রোতগুলোকে। আজকের দিনে এই অবস্থা গ্রহণযোগ্য নয়; এই অপশক্তির বিরুদ্ধে দাঁড়ানো আমাদের নৈতিক এবং নাগরিক কর্তব্য।
গ্রামে যে মানুষেরা কুকুরকে বাঘ, কাককে ময়ুর মনে করে – তাদের এই ভয়কে দমন করা সহজ কাজ নয়। কিন্তু ভয়কে শক্তি-ক্ষোভে পরিণত না করে সচেতনতা, শিক্ষা ও ঐক্যের মাধ্যমে বদলে ফেলা সম্ভব। এই কলামে আমি কিছু বাস্তবধর্মী পথ, ধারণা ও অনুপ্রেরণা তুলে ধরছি – যেগুলো ব্যবহার করে গ্রামকে এই অন্ধকার থেকে আলোকিত করা সম্ভব।
প্রথমত – জ্ঞানসাক্ষরতা ও নাগরিক শিক্ষাঃ
ভয়ের মুল উন্নত শিক্ষা না থাকায়। তাই দরকার মৌলিক নাগরিক শিক্ষা – ভোটের অধিকার, আইনী প্রক্রিয়া, ভূমি ও শ্রমের অধিকার, local governance কিভাবে কাজ করে— এসব বিষয়ে সরল ও সহজ ভাষায় মানুষকে জানাতে হবে। বিদ্যালয়, মসজিদ/মন্দিরের পথ, স্থানীয় গ্রুপ মিটিংগুলোকে ব্যবহার করে নিয়মিত সেশন চালালে ধীরে ধীরে মানুষের ভীতি কমে আসে। জানা হলেই ভয় হঠে, আর ভয় না থাকলে শোষক শক্তি কাজ করতে পারে না।
দ্বিতীয়ত – স্থানীয় নেতৃত্ব গঠন ও তরুণদের সম্পৃক্তকরণঃ
গ্রাম্য রাজনীতির অপশক্তির বিরুদ্ধে সবচেয়ে শক্তিশালী প্রতিরোধ হচ্ছে স্বচ্ছ ও দায়বদ্ধ স্থানীয় নেতৃত্ব। এটাকে বিকশিত করতে হবে -এমন নেতাদের উদ্ভব করতে হবে যারা ব্যক্তিগত স্বার্থের বাইরে জনগণের কথা চিন্তা করে। তরুণ প্রজন্মকে রাজনীতিতে, সামাজিক কার্যক্রমে আকৃষ্ট করতে হবে -সাহসী, দক্ষ ও নৈতিক নেতৃত্ব গড়ে তুলতে হবে। কমিটি, সাংস্কৃতিক দল বা স্বেচ্ছাসেবী গ্রুপ তৈরি করে তারা বাস্তবে কাজ শেখাতে হবে।
তৃতীয়ত – সামাজিক সমন্বয় ও সংহতিঃ
ভয়ের বিপরীতে সবচেয়ে কার্যকরী অস্ত্র হল সংহতি। এককভাবে একজন প্রতিবাদ করলে সে ভাঙিয়ে ফেলা সহজ; কিন্তু যখন পুরো গ্রাম ঐক্যবদ্ধ হয়, তখন অপশক্তির কাজ বন্ধ হয়ে যায়। ছোট ছোট কম্যুনিটি কৌশল যেমন -পাশের বাড়ির লোকের সাথে মিলিত হওয়া, সমস্যার নথিভুক্তকরণ, স্বাক্ষর সংগ্রহ-এগুলো সহজ কিন্তু শক্তিশালী উপায়। প্রতিবাদ হলে শান্তিপূর্ণ ও সাংবিধানিক পদ্ধতিই অগ্রাধিকার দিন।
চতুর্থত- তথ্য ও যোগাযোগের শক্তি ব্যবহারঃ
মোবাইল ফোন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, স্থানীয় পত্রিকা – এসব এখন আর শহরের একচেটিয়া বিষয় নয়। গ্রামীণ মানুষকেও এই চ্যানেলগুলো ব্যাবহার করে নিজেদের কণ্ঠ পৌঁছে দিতে হবে। তথ্য রেকর্ড করা (ভিডিও, ছবি, প্রত্যয়নপত্র) এবং তা বিস্তৃতভাবে শেয়ার করা অনেক সময় তৎকালীন শক্তিকে থামিয়ে দেয়। তবে তথ্য ছড়ানোর সময় সতর্কতা ও নৈতিক দায়িত্বও রাখতে হবে-গুজব ও অপপ্রচার না ছড়ানোর, ব্যক্তিগত নিরাপত্তা বজায় রাখার।
পঞ্চমত – আইনি সহায়তা ও মানবাধিকার সংগঠনগুলোর সাথে যোগাযোগঃ
যখন কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠী নিঃশর্তভাবে অত্যাচার করে, তখন আইনের সাহায্য নেওয়া জরুরি। স্থানীয় আইনজীবী, মানবাধিকার সংগঠন, জেলা প্রশাসন — এসব প্রতিষ্ঠানকে সচেতন করে উপযুক্ত ফাইলিং ও প্রটোকল মেনে মামলা, সমন, পক্ষপাতহীন তদন্তের দাবি তুলতে হবে। আইনি জ্ঞান ছড়িয়ে দেয়ার মাধ্যমে মানুষ নিজের অধিকার রক্ষা করতে শিখবে।
পরিশেষে – নীরবতা ভেঙে সাহসী হওয়াঃ
সবচেয়ে বড় বাধা হল ভীতি ও সংযম। কিন্তু মনে রাখতে হবে – সাহস কোনোদিন ঝুঁকি নেওয়া নয়; তা হচ্ছে নিয়মিত, স্বচ্ছ ও বুদ্ধিমান কাজ। গ্রাম্য রাজনীতির অপশক্তির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো মানে প্রতিবাদ, কিন্তু সেই প্রতিবাদ হলে শান্তিপূর্ণ, নৈতিক ও আইনগতভাবে সঠিক হওয়া আবশ্যক। লড়াই করতে গেলে সংগ্রহশীলতা, পরিকল্পনা ও একতার প্রয়োজন — এ ছাড়া কোনো দ্রুত ফল আশা করা উচিত নয়; পরিবর্তন সময়সাপেক্ষ, ধৈর্য্যশীল প্রক্রিয়া।
আসুন—ভয়কে জয়ের মাধ্যমে গ্রামের মানুষকে তাদের মর্যাদা ফিরিয়ে দেওয়ার লক্ষ্যে একসাথে কাজ করি। ছোট ছোট পদক্ষেপই বড় পরিবর্তনের বীজ রোপণ করে।
এস এম আওলাদ হোসেন।
সাংবাদিক ও কলামিস্ট।
01637654471
|